



অফিসটাইমের ভিড়, থিকথিকে জ্যাম কাটিয়ে ধর্মতলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ৫৭ নম্বর রুটের বাসটা। বাসের ভেতরে বাদুরঝোলা অবস্থা।




তায় ভিড় কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এক মাঝবয়সী মহিলা। পরনে সস্তার শাড়ি, আঁচলটা গোঁজা কোমরে, কপালে সিঁদুর, বুকের কাছে একটা ব্যাগ।




দেখে মনে হবে বছর পঞ্চাশের দুঃখী সধবা। কেউ দয়াপরবশ হয়ে দু দশটাকা ভিক্ষা স্বরুপ এগিয়ে দিতেই মৃদু ধমক মহিলার। বলে ওঠেন,
“এই টাকাটা রেখে আমায় বাসভাড়াটা দিন। আমি বাসের কন্ডাক্টর।” ডান হাতের মুঠোয় ধরা টিকিটের গোছাটা তুলে ধরেন। মহিলার দৃপ্ত দৃষ্টি, আত্মবিশ্বাসী মেরুদন্ড আর বজ্রনিনাদ কন্ঠ। বলে চলেন, “আমার নাম ডলি রানা। বাড়ি হাওড়ার বেলগাছিয়ায়। তবে আমি বাসের পেশাদার কন্ডাক্টর নই, বাসের মালিক। বাসটা আমার সন্তানের মতো। তাই বাসটাকে বাঁচাতেই কন্ডাক্টারি করছি বছর খানেক ধরে।” বলে চলেন, “আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কিন্তু আমার বাবা সুরেশ ঘোষ স্বপ্ন দেখতেন, তিনি বাস মালিক হবেন। এর জন্য জীবনের শেষ বয়সে এসে তাঁর জমানো টাকা দিয়ে বাস কেনার চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু টাকা খরচ করেও সেটা করতে পারেননি। ফলে তিনি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা পূর্ণলক্ষ্মীও তাই।” থামেননি ডলি, বলেন, “বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণ করতেই ভাই বোনেরা মিলে নিজেদের সোনা-দানা বেচে ২০১৬ সালে সেকেন্ডহ্যান্ড বাসটা কিনি। সেটা দেখেই মা-বাবা মারা যান।” বাস কেনা হল। কিন্তু ডিজেল খরচ, ড্রাইভার কন্ডাকটারের মাইনে ও মাসে মাসে ৩০ হাজার করে ধার শোধ কঠিন হয়ে পড়ছিল তাঁর পক্ষে। তায় আবার এলো করোনা। একেবারে ধ্বসে পড়ল সব। দেনার দায়ে ডুবিডুবি অবস্থায় কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডলি? বললেন, “সারা দিনে বাস চালিয়ে কন্ডাক্টর রাতে এসে ১০০ টাকা হাতে দিত। অনেকে সে সময় আমায় পরামর্শ দেয় বাসটা বিক্রি করে দেওয়ার। কিন্তু বাসটা তো আমার শুধু রুটি রোজগারের নয়, ওটা তো আমার কাছে সন্তানের মতো।”
ডলি জানান, সেসময় বাস ড্রাইভার লালন তাকে কন্ডাকটারির ট্রেনিং দিত। ডলির কথায়, “ভোর সওয়া পাঁচটার বাসে বেশি ভিড়ভাট্টা হত না। লালনই তখন বলে, তুমি এই ট্রিপটা করো দিদি। তখন ব্যাগ কেনা হয়নি। চাদরের কোঁচড়ে খুচরো রেখে টিকিট কাটা শুরু করি। তখনই দেখি নিজে কাজ করলে বেশি রোজগার হচ্ছে। আর এখন তো চার-পাঁচ ট্রিপ করে দিনের শেষে ঘরে দু-আড়াই হাজার টাকা আনছি। আর ৩০ হাজার টাকা লোন শোধ হয়ে গেলেই বাসের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট পেয়ে যাব ব্যাঙ্ক থেকে। তারপর আরও একটা বাস কিনব।” ডলির সিদ্ধান্তে কি বলেছিলেন স্বামী বরুন ঠিকাদার যার পেশা রং করার ঠিকাদার। ডলি বলে, “প্রথম দিকটায় খুব আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, খাওয়া-পরার যখন অভাব নেই, তখন কেন এমন কঠিন কাজে নামছো? পরে অবশ্য আমাকে সমর্থন করছে। পাশেও আছে।” পরিবহন শিল্পের ভরাডুবির দিনে এই বাস এক ভালো’বাসা’।